আবার, আমরা যদি আদি পুস্তক ১০ অধ্যায় পড়ি, তাহলে সেখানে নিম্নোদ নামে একটি চরিত্র বর্ণনা করা হয়েছে (আদি পুস্তক ১০:৮-১২ পদ দ্রষ্টব্য)। ঈশ্বর কেন হামের প্রথম সন্তান, কুশের ষষ্ঠ সন্তান নিম্রোদ সম্পর্কে আমাদের বলতে চেয়েছেন? কারণ, হামের নাতি নিম্নোদই পরবর্তীতে বাবিলীয় ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা হয়েছিল। এটাই হচ্ছে মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রথম সংগঠিত ধর্ম। এখন আমরা লক্ষ্য করি, কিভাবে তা বাস্তবায়িত হয়েছিল।
হামের প্রথম ছেলে কৃশের ছয়টি পুত্র সন্তান ছিল (আদি পুস্তক ১০:৭-৮ পদ দ্রষ্টব্য)। তাদের পাঁচ জনই আরব ও আফ্রিকা অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসবাস করেছিল। কিন্তু নিগ্রোদ টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর কাছে আজকের ইরাক অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছিল।। একটা কথিত কাহিনী হচ্ছে, নিম্রোদের সাথে তার সবচেয়ে ছোট কাকা কমানের বিশেষ বন্ধুত্ব সম্পর্ক ছিল। কনানের কথা আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে। কনানের পিতামহ নোহ যখন আংগুর-রস খেয়ে মাতাল অবস্থায় উলংগ হয়ে ঘুমিয়েছিলেন, তখন কনান তার বাবা হামের সাথে মিলে নোহের উলংগতা ঢেকে দেয় নাই।। কিন্তু হাম তার অন্য দুই ভাই শেম ও যেফতকে তাদের বাবার উলংগতার কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন। এই কারণে হামের ছেলে কনানকে তার পিতামহ নোহ অভিশাপ দিয়েছিলেন (আদি পুস্তক ৯:২৫ পদ দ্রষ্টব্য)। তবে এই কথিত কাহিনীর সাথে বাইবেলের পুরোপুরি মিল পাওয়া যায় না।
তারপর থেকে, হামের সাথে তার বাবা নোহের সম্পর্ক খুব একটা ভাল যায় নাই। দিশেষ করে, তার প্রথম সন্তান কুশের বংশে যখন নিম্রোদের জন্য হয়েছিল (কুশের সর্বশেষ সন্তান), তখন মনে হয় তাদের সম্পর্ক আরও বেশী তিক্ততার পর্যায়ে দিয়েছিল। সেজন্য তিনি (হাম) তার নাতির নাম নিম্নোদ রেখেছিলেন, যার মানে- 'এসো আমরা বিদ্রোহ করি'। এই নাম মূলত চরম বিদ্রোহ ও যুদ্ধের মনোভাব (E. A. Speiser. In Search of Nimrod, Eretz Israel 5, 1958. PP. 32-35)। তরুণ বয়স থেকেই নিম্রোদের চরিত্রের বৈশিষ্ট্যে ছিল বিদ্রোহী মনোভাব। তিনি খুব সাহসী এবং যুদ্ধে পটু ছিলেন বলে ঐ এলাকার কেউই ভার বিপক্ষে যেত না। সেই জন্য বাইবেলে বলা হয়েছে, "এই নিম্নোদ পৃথিবীতে একজন ক্ষমতাশালী পুরুষ হয়ে উঠেছিলেন” (আদি পুস্তক ১০:৮ পদ)।
নিম্নোদ যে সময়ে বাস করতেন, তখন মানুষের জীবনের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয়তা ছিল চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল, যেমন: খাবার-দাবার, কাপড়-চোপড় ও আশ্রয় ইত্যাদির অভাব ছিল। এই সবের মূল কারণ ছিল মহা-বন্যা। মূলত, মানুষ তখনকার দিনে শুধুমাত্র বীজ বিশিষ্ট ফল খেতে অভ্যস্ত ছিল। ঈশ্বর যখন মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন, তখন তিনি তাদের খাবারের ব্যবস্থা করেছিলেন: "দেখ, পৃথিবীর উপরে প্রত্যেকটি শস্য ও শাক-সব্জী যার নিজের বীজ আছে এবং প্রত্যেকটি গাছ যার ফলের মধ্যে তার বীজ রয়েছে সেগুলো আমি তোমাদের দিলাম। এগুলোই তোমাদের খাবার হবে” (আদি পুস্তক ১:২৯ পদ)। কিন্তু আদমের পতনের পর ঈশ্বর ক্ষেতের ফসল খাবার অনুমতি দিয়েছিলেন (আদি পুস্তক ৩:১৮ পদ দ্রষ্টব্য)।
কিন্তু মহা-বন্যার পরে, ঈশ্বর মানুষকে মাংস খেতে অনুমতি দিয়েছিলেন। "জীবন্ত ও ঘুরে বেড়ানো সমস্ত প্রাণীই তোমাদের খাবার হবে। খাবার হিসাবে আমি আগে যেমন তোমাদের শস্য ও শাক-সব্জী দিয়েছিলাম তেমনি এখন এই সবও তোমাদের দিলাম” (আদি পুস্তক ৯:৩ পদ)। তাছাড়াও জীব-জন্তুরাও খাবার হিসাবে মাংস খেতে শুরু করেছিল, কারণ বীজযুক্ত ফল, শস্য ও শাক-সব্জী মহা- বন্যার পরে দুষ্প্রাপ্য ছিল। বাঘ অথবা সিংহও মূলত তা-ই খেত, কিন্তু বন্যার পরে তারা শিকারী প্রাণীতে পরিণত হয়েছিল এবং তারা মানুষও ধরে খেতে শুরু করেছিল। তাই, এই সময় লোকেরা একজন 'সাহসী শিকারীর' প্রয়োজন অনুভব করেছিল, যে কি না ভাল শিকার করতে অভান্ত এবং শক্তিশালী পশুদের হাত থেকে তাদের রক্ষা করতেও সমর্থ।
আদি পুস্তক ১০:৯ পদে নিম্নোদকে একজন সাহসী "বেপরোয়া শিকারী" হিসাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। তিনি সেই সময়ের একজন শ্রেষ্ঠ শিকারী ছিলেন। তিনি জীব-জন্তু শিকার করতেন এবং লোকদের খাবারের যোগান দিতেন (সেই সাথে খাবার-দাবার, কাপড়-চোপড় ও আশ্রয়ের যোগানদাতাও হয়ে উঠেছিলেন)। এমন কি, তিনি বুনো জীব-জন্তুর আক্রমণ থেকে লোকদের রক্ষাও করতেন (জীবন- রক্ষাকারী)। ফলে, নিম্নোদ লোকদের কাছ থেকে সম্মান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং ক্রমশ তাদের চোখে ঈশ্বর সমতুল্য হয়ে উঠেছিলেন। আদি পুস্তক ১০:১০-১২ পদে নিম্রোদের এলাকা বৃদ্ধি পাবার কথা বলা হয়েছে। তিনি। তার এলাকা শিনিয়র দেশ (আজকের ইরাক ও পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল) থেকে আসিরিয়া (আজকের সিরিয়া) পর্যন্ত বিস্তার করেছিলেন। তিনি ইউফ্রেটিস নদীর কাছে তার রাজধানী হিসাবে বাবিল শহর তৈরী করেছিলেন। একজন 'মহা পরাক্রমশালী' এবং "বেপরোয়া শিকারী" হিসাবে নিম্নোদ তার রাজ্যের সব লোকদের একতাবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং তার নাম উঁচুতে তুলে ধরার জন্য তখনকার পৃথিবীতে তার প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি বাবিলে এক উঁচু ঘর তৈরী করতে শুরু করেছিলেন, যা শহরের আকাশ পর্যন্ত ছুঁতে পারে (আদি পুস্তক ১১:৪ পদ দ্রষ্টব্য)।
বাবিল শব্দের অর্থ হচ্ছে "ঈশ্বরের কাছে যাবার পথ।" এ থেকে বোঝা যায় যে, নিম্নোদ নিজে নিজে বাবিলের উঁচু ঘরের উপরে উঠে লোকদের কাছ থেকে ঈশ্বরের গৌরব নিজে পেতে চেয়েছিলেন। নিম্নোদ একজন ঈশ্বর হতে চেয়েছিলেন, যেন লোকেরা তার চারপাশে জড়ো হয়ে তার উপাসনা করে। বাবিলীয় ধর্মের শুরু হচ্ছে এটাই [" Who is the founder of the Babylonian Religion?" সংক্ষিপ্ত মন্তব্য-২, পৃষ্ঠা: ৪৯ দ্রষ্টব্য]।
ইয়াওয়ে সদাপ্রভু নিম্রোদের এই ধরনের কাজে মোটেই খুশী হতে পারেন নাই (আদি পুস্তক ১১:৪-৬ পদ দ্রষ্টব্য)। সেই সময়ে যে ৭০ গোষ্ঠী মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ছিল, তাদের সকলেরই ছিল এক ভাষা এবং তাদের শব্দের উচ্চারণও একই রকম ছিল (আদি পুস্তক ১১:১ পদ দ্রষ্টব্য)। তারা সকলেই নিম্রোদের শাসনের অধীনে ছিল, কারণ তিনি ছিলেন যুদ্ধের ক্ষমতা সম্পন্ন রাজনৈতিক শাসক। কিন্তু ইয়াওয়ে সদাপ্রভু হঠাৎ করেই তাদের এক ভাষাকে ৭০ টা আলাদা আলাদা ভাষায় ভাগ করে দেন। অতঃপর, তাদের মধ্যে গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে যোগাযোগ নষ্ট হয়ে যায়। এবং তারা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। এইভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করতে করতে তারা বাবিলীয় ধর্মের অনুরূপ নানারকম ধর্মমতের উদ্ভাবন করে, কারণ তারা তো বাবিলীয় ধর্মকেই বিশ্বাস করত। তারা বিভিন্ন দেব-দেবতার পূজা শুরু করে। এই ধরনের পূজার প্রক্রিয়া আজ পর্যন্ত বহাল রয়েছে।
এই অধ্যায়ে এখন পর্যন্ত আমরা যা কিছু আলোচনা করেছি, তা একটা নির্দিষ্ট ছকে সৃষ্টির আগে 'যীশুর অনন্তকাল সময় থেকে অব্রাহাম পর্যন্ত' সময়ের ধারাবাহিক প্রেক্ষাপট উল্লেখ করা হয়েছে। এই সময়ের ধারাবাহিক তালিকা বিষয়টা বুঝতে পাঠকদের সাহায্য করবে।
0 coment rios: