সংবাদ শিরোনাম
লোডিং...
Menu

Friday, December 6, 2024

যীশুর অস্তিত্ব কি আসলেই ছিলো?


নাস্তিক পণ্ডিতদের এই দাবি মূলত ঐতিহাসিক প্রমাণের অভাব ও ধর্মীয় গ্রন্থের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতার সমালোচনার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। তারা মনে করেন, বাইবেলে যীশুর জীবনের বিবরণগুলো ঐতিহাসিক তথ্যের চেয়ে ধর্মীয় বিশ্বাস এবং রূপক গল্পের উপর বেশি নির্ভরশীল।

তবে একইসঙ্গে অনেক ঐতিহাসিক এবং গবেষক বলেন, যীশুর অস্তিত্ব নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, প্রথম শতাব্দীর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তাঁর বাস্তবিক উপস্থিতি নিশ্চিত করার মতো পর্যাপ্ত ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ট্যাকিটাস, জোসেফাস, এবং সুয়েটোনিয়াসের মতো কিছু প্রাচীন ঐতিহাসিক সূত্রে যীশুর কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যদিও এসব উল্লেখ দ্ব্যর্থপূর্ণ এবং পর্যালোচনার জন্য উন্মুক্ত।
 খ্রিস্টান ধর্মকে পরাস্ত করার তাড়নায় কয়েকজন নাস্তিক পণ্ডিত দাবি করেছেন যীশু বলে কারো অস্তিত্বই ছিলো না। 

ড. হুমায়ুন আজাদসহ অনেকেই মনে করেন, যীশুর অস্তিত্ব নিয়ে আলোচনা পুরোটাই একটি ঐতিহাসিক নির্মাণ বা কল্পনা।
সাদা চামড়ার রূপে মুগ্ধ হয়ে বঙ্গীয় পণ্ডিত ড. হুমায়ুন আজাদ চিৎকার করে বলেছেন :

“মানুষ কতোটা মিথ্যা বলতে ও বিশ্বাস করতে পারে, তার অসামান্য উদাহরণ জেসাস বা খ্রিষ্ট । জেসাস মানুষের শ্রেষ্ঠ কল্পচরিত্র : গত দু-শো বছরের বাইবেলবিজ্ঞানীরা, যাঁদের অনেকেই ধার্মিক ও পুরোহিত, প্রমাণ করেছেন যে জেসাস নামে কেউ ছিলো না।… জেসাসকে সৃষ্টি করা, তাকে ঘিরে পুরাণ, ও একটি নতুন ধর্ম বানানোর সমস্ত কৃতিত্ব খ্রিষ্টান সুসমাচারপ্রণেতাদের । ক্রাইস্ট এক কিংবদন্তি বা পুরাণ…”

হুমায়ুন আজাদ, আমার অবিশ্বাস; পৃ. ৯০

তিনি ডেভিড স্ট্রস-এর বইয়ের কথা উল্লেখ করেছেন উনার দাবির পক্ষে। ডেভিড বেশ প্রভাবশালী লেখক ছিলেন। একজন বস্তুবাদী গবেষক হিসেবে তিনি মিথতত্ত্ব (Myth theory)-এর দৃষ্টিতে যিশুর জীবনকে দেখার চেষ্টা করেন এবং সিদ্ধান্ত দেন যিশু বলে কারও অস্তিত্ব আসলে ছিল না। সুসমাচার (Gospel) লেখকেরা জেসাস ক্রাইস্টকে তৈরি করেছেন। তৎকালীন সময়ের অনেকেই নাকি দাবি করেছে যে-জেসাসকে তৈরি করা হয়েছে তাইয়ানার দার্শনিক অ্যাপোলোনিয়াসের আদলে। সাম্প্রতিক সময়ে নাস্তিক ফরাসি দার্শনিক মাইকেল অনফ্রে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থেও বলতে চেয়েছেন, যিশু হলেন কেবলই এক অনুকল্প!

কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো অধ্যাপক আজাদ সাহেবের আরও অনেক দাবির ন্যায় এই দাবিও ভুল। অধ্যাপক সাহেবের নিজের এজেন্ডার সাথে মিলে যাওয়ায় তিনি ডেভিড স্ট্রসের বক্তব্যকে প্রশ্ন করেননি; যদিও তিনি নাকি বিনা প্রশ্নে কিছু মানতে চাইতেন না। আমরা প্রশ্ন করি চলুন। মিথতত্ত্বওয়ালাদের বক্তব্য কি সঠিক? সঠিক উত্তর, না!

যিশুর অস্তিত্ব যে আসলেই ছিল তার পক্ষে যথেষ্ঠ প্রমাণ রয়েছে। সাম্প্রতিক কালে বাইবেল গবেষক মরিস কেইসি Jesus: Evidence and Argument or Mythicist Myths? গ্রন্থে মিথতত্ত্বওয়ালাদের উত্থাপিত নানা দাবির উত্তর দিয়ে দেখিয়েছেন যিশু অস্তিত্ব আসলেই ছিল। আমেরিকার প্রসিদ্ধ বাইবেল বিশারদ এবং ওরিগন স্টেট ইউনিভার্সিটির রিলিজিয়ন এন্ড কালচার বিভাগের সাবেক প্রফেসর মার্কাস বর্গ এ প্রসঙ্গে বলেন :

“যদিও সাম্প্রতিক গুটিকয়েক বই এ দাবি উত্থাপন করছে যে যিশুর অস্তিত্বই কখনোই ছিল না । তবে তাঁর অস্তিত্বের পক্ষে যে প্রমাণ পাওয়া যায় তা অধিকাংশ খ্রিষ্টান বা অখ্রিষ্টান পণ্ডিতকেই এমতে প্ররোচিত করেছে যে, সত্যি তাঁর অস্তিত্ব ছিল ।”

Natalie Wolchover, Was Jesus a Real Person? LiveScience

বর্তমান কালের একজন বিখ্যাত বাইবেল বিশারদ হলেন ড. বার্ট ডি. আরমেন। খ্রিষ্টধর্মে বড় হয়ে সেই ধর্মের কাজেই নিজেকে নিয়োজিত করতে তিনি বাইবেল পড়া শুরু করেন।

বাইবেলের নানা অসংগতি চোখে পড়তে থাকলে তা নিয়ে নিরপেক্ষভাবে ভাবার চেষ্টা করেন। বাইবেল ও খ্রিষ্টধর্ম গবেষণাকেই নিজের ক্যারিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেন। পরিশেষে, দর্শনগত কারণে খ্রিষ্টধর্ম ছেড়ে দিয়ে নিজেকে অজ্ঞেয়বাদী, হিউম্যানিস্ট হিসেবে পরিচয় দেন। তবে অন্যান্যদের সাথে উনার পার্থক্য হলো, উনি গোঁড়া ধর্মবিদ্বেষী নন।

আসলেই যিশুর অস্তিত্ব ছিল কি না, সেটা তিনিও গবেষণা করেছেন। দীর্ঘ গবেষণা শেষে তিনি তাঁর Did Jesus Exist? The Historical Argument for Jesus of Nazareth গ্রন্থে বাইবেলের পাশাপাশি অন্যান্য ঐতিহাসিক প্রাচীন নথিপত্র উল্লেখ করে প্রমাণ করেছেন, যিশুর অস্তিত্ব ছিল; কেউ তা পছন্দ করুক বা নাই করুক, কিছুই যায় আসে না। দার্শনিক অ্যাপোলোনিয়াসের অস্তিত্ব যেমন ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত, যিশুর অস্তিত্বও ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। পাশাপাশি যারা যিশুর অস্তিত্ব অস্বীকার করতে চায়, তিনি তাদের গোমর ফাঁস করে দিয়েছেন। তিনি বলেন : যিশুর অস্তিত্ব অস্বীকারকারী মিথতত্ত্বওয়ালারা মূলত চরম ধর্মবিদ্বেষী। তাদের চারপাশে প্রধানত খ্রিষ্টান ধর্মের প্রাধান্য ছিল। তাই ধর্মকে আক্রমণ করতে চাইলে খ্রিষ্টবাদের কেন্দ্রীয় চরিত্র যিশুর অস্তিত্ব নিয়ে ভেজাল লাগিয়ে দেওয়ার চেয়ে সহজ কাজ আর কীই হতে পারে?

ড. বার্ট ডি. আরমেন-এর মতে মিথতত্ত্বওয়ালাদের এহেন আচরণও গোঁড়া ধর্মান্ধদের আচরণের সমতুল্য। তবে তিনি এটাও দেখিয়েছেন, খ্রিষ্টানরা আজ যে যিশুকে চেনে, আসল যিশু তেমন ছিলেন না। তিনি বলেন :

“আমার দৃষ্টিতে, হিউম্যানিস্ট, সংশয়বাদী, নাস্তিক, মিথতত্ত্বওয়ালা বা অন্য কেউ যারা যিশুর অস্তিত্বকে মানতে চান না, তাদের জন্য যিশুর অস্তিত্ব একেবারেই ছিল না এমন ভুল দাবি করার চেয়ে, ইতিহাসের যিশু আর আজকের খ্রিষ্টবাদের যিশু যে এক নয়, এদিকটায় জোর দেওয়াই অধিক উত্তম । যিশুর অস্তিত্ব ছিল। তবে আজকের খ্রিষ্টবাদে বিশ্বাসীরা তাকে যেমনটা ভেবেছে তিনি তেমন ছিলেন না, ব্যস ।”

Bart D. Ehrman, Did Jesus Exist? The Historical Argument for Jesus of Nazareth; Part III : conclusion (Epub Edition, HarperCollins e-books, 2012)

প্রফেসর বর্গের মতেও, যিশু নতুন কোনও ধর্ম বানাতে চাননি। তিনি মোশি’র (মুসা আ) এর আইন বাতিল করতে আসেন নি, বরং পূর্ণ করতে এসেছেন। (ম্যাথু ৫:১৭) তিনি ইয়াহূদি ধর্মের মাঝেই নিজেকে দেখেছিলেন। কিন্তু মৃত্যুর পর তাঁর অনুসারীরা তাঁকে খোদার আসনে বসায়।

এতক্ষণের আলোচনা পড়ে কেউ যদি বলে – মানুষ কতোটা মিথ্যা বলতে ও বিশ্বাস করতে পারে, তার অসামান্য উদাহরণ হুমায়ুন আজাদ ও তার সমমনারা, তাহলে তাদের এহেন যৌক্তিক সমালোচনাকে কি দোষ দেয়া যায়?


লেখাটি বেস্ট সেলার গ্রন্থ অবিশ্বাসী কাঠগড়ায় বইয়ের তৃতীয় অধ্যায় থেকে গৃহীত।


শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.

0 coment rios: