লুসিফারের পরিচয়
মূলত, লুসিফার মানে "আলো বহনকারী”। এই নাম ছিল সত্যিই সৌন্দর্যে পূর্ণ এক গৌরবময় নাম (যিশাইয় ১৪:১২। যিহিস্কেল ২৮-১২-১৪ পদ দ্রষ্টব্য)। লুসিফারের পতনের পর ঈশ্বর তার এই নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম দেন। এই নতুন নাম হচ্ছে শয়তান। গ্রীক ভাষায় বলা হয় স্যাটানাস (SATANAS) যার মাস, "যে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে"। এই স্যাটানাস শব্দ থেকে ইংরেজিতে স্যাটান এবং বাংলায় শয়তান লেখা হয়ে থাকে। লুসিফার ঈশ্বরের মত হতে চেষ্টা করেছিল এবং ঈশ্বরের সৃষ্ট সবকিছুর কাছ থেকে গৌরব, প্রশংসা, সম্মান ও উপাসনা পাবার আকাংখা করেছিল, যা প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সামিল। এই কারণে তার নাম শয়তান দেওয়া হয়।
আবার ঈশ্বর শয়তানকে আরও একটা নাম দেন, তা হচ্ছে গ্রীক ভাষায় দিয়াবলোস (DIABOLOS), যা ইংরেজিতে বলা হয় ভেভিল (DEVIL) এবং বাংলায় বলা হয় দিয়াবল। এই শব্দের অর্থ হচ্ছে একজন 'ধ্বংসকারী' অথবা একজন 'বিভেদ সৃষ্টিকারী'। এই নাম যেভাবে নির্দেশ করেছে, সেভাবে- লুসিফারের নাম পরিবর্তন করে শয়তান এবং আরও ঘৃণিতভাবে দিয়াবল বলে জাত্য হয়ে থাকে, যাতে প্রথম ও দ্বিতীয় স্বর্গের সমস্ত সৃষ্টির ধ্বংসকারী বলা হয়।
তাছাড়াও, শয়তানের কাজ হচ্ছে ঈশ্বরের সৃষ্টির উদ্দেশ্যকে ঈশ্বরের ইচ্ছামত চলতে বাধাগ্রস্থ করা। কিন্তু ঈশ্বরের সব কিছু সৃষ্টির উদ্দেশ্য ছিল যেন তাঁর সৃষ্টি তাঁর গৌরব করে (যিশাইয় ৪৩:৭, ২১; রোমীয় ৯০৫; কলসীয় ১:১৬ পদ দ্রষ্টব্য)। ঈশ্বর ও তাঁর সৃষ্টির মধ্যে বিভেদ ও পার্থক্য জন্মাতে সে সব সময় সচেষ্ট থাকে। সে ঈশ্বরের সৃষ্ট প্রাণীদের ঈশ্বরের উপাসনা না করতে প্রলুব্ধ করে এবং তাকে ও তার মূর্তির পূজা করতে প্ররোচিত করে। এই দৃষ্টিকোণে, শয়তানের নাম 'বিভেদ সৃষ্টিকারী'। বাস্তবিক পক্ষে, ঈশ্বর (নতুন নিয়মের যীশু) যেভাবে শয়তান সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন, সেভাবে মূলত বাবিলীয় ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছে দিয়াবল বা শয়তানের বংশধর।
এই কারণে, বাইবেলে পতিত লুসিফারকে শয়তান বা দিয়াবল বলে উল্লেখ করা হয়েছে (লুক ১০:১৮; যিহূদা ১:৬, ৯; প্রকাশিত বাক্য ১২:৯: ২০:২ পদ দ্রষ্টব্য)। এই দুটো নাম প্রকৃতপক্ষে একজনকেই উদ্দেশ্য করে বলা হয়, সে হচ্ছে পতিত লুসিফার। তবে অন্যদিকে, শাস্ত্রের কোন কোন পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও পূর্বসূত্র অনুসারে "দিয়াবল" কে শয়তান বা শয়তানের অনুসারী হিসাবে ব্যাখ্যা করা
শয়তানের বৈশিষ্ট্য
বাইবেলে এমন অনেক শব্দ বা শব্দসমষ্টি রয়েছে, যা মূলত গতিস্থ লুসিফারকে তুলে ধরতে ব্যবহার করা হয়েছে। তাকে আবার সেই পুরানো সাপ, ড্রাগন বা দানব বলেও ডাকা হয় (প্রকাশিত বাক্য ১২:৯। ২০:২ পদ), জগতের কর্তা (যোহন ১২:৩১ পদ), এ যুগের দেবতা (২ করিস্থীয় ৪:৪ পদ), আকাশের ক্ষমতাশালীদের রাজা (ইফিষীয় ২:২ পদ), অতল গর্তের দূত, আবদ্দোন, আপল্লুয়োন (প্রকাশিত বাক্য ৯:১১ পদ), আগুনের মত লাল একটা বিরাট সানর (প্রকাশিত বাক্য ১২:৩ পদ), দোষারোপকারী (প্রকাশিত বাক্য ১২:১০ পদ), বেলসকূল বা মন্দ আত্মাদের রাজা (মথি ১২:২৪ পদ), বাবিলের রাজা (যিশাইয় ১৪:৪ পদ), সোরের রাজা (যিহিস্কেল ২৮:১২ পদ), পারস্যের রাজা (দানিয়েল ১০:১৩ পদ) এবং যে পৃথিবীর লোকদের ভুল পথে নিয়ে যায় (প্রকাশিত বাক্য ১২:৯ পদ)।
শয়তান কিভাবে মানব সমাজের বিভ্রান্ত করে।
২ করিন্থীয় ৪:৪ পদে প্রেরিত্ পৌল শয়তানকে "এই যুগের দেবতা" বলেছেন, তার কারণ হচ্ছে- পৃথিবীর লোকেরা পতিত লুসিফার ও তার বংশধরদের ঈশ্বর বা দেবতা মনে করে স্ব স্ব ধর্মের নামে উপাসনা করছে। এই পৃথিবীর প্রথম ধর্ম হচ্ছে বাবিলীয় ধর্ম এবং সারা পৃথিবীর সকল ধর্ম মূলত বাবিলীয় ধর্ম থেকে উদ্ভব হয়েছে। অন্যভাবে, বাবিলীয় ধর্মের প্রভাবে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েই মূলত নানারকম ধর্ম ও মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রাচীন মিসর, গ্রীস ও রোমের পৌরাণিক কাহিনীতে উল্লেখিত দেব-দেবী, হিন্দু ধর্মের দেব-দেবী, বৌদ্ধ ধর্মের বুদ্ধদেব ও ছোট বুদ্ধ, এমন কি ইসলাম মতবাদ, ক্যাথলিক মতবাদ, শিখ মতবাদ, জেরোয়াস্টার প্রতিষ্ঠিত মতবাদ, শিন্টো মতবাদ, কনফুসিয়াস মতবাদ, আঙ মতবাদ, সর্বপ্রাণবাদ, সামান মতবাদ (ভাল ও মন্দ উভয় আত্মায় বিশ্বাসী ওঝা), প্রাচীন লোক ধর্ম, বাহাই মতবাদ, নতুন যুগের আন্দোলন এবং ধর্মীয় বহুত্ববাদ ইত্যাদিও বাবিলীয় ধর্মের প্রভাবের বাইরে নয়।
সত্যিকারভাবে, এখানে সকলের মধ্যে পতিত লুসিফার ও তার অনুসারীদের লক্ষ্য করতে পারি। এভাবেই পতিত লুসিফার মানবজাতিকে পৃথিবীতে উদ্ভুত নানা ধর্মের নামে ঠকিয়ে যাচ্ছে এবং লাগাতারভাবে তার উপাসনা করতে প্ররোচিত করে যাচ্ছে। বাবিলীয় দেব-দেবতারা এক এক এলাকাতে, সংস্কৃতি ও জাতি- গোষ্ঠীতে গিয়ে অন্যভাবে রূপান্তরিত হয়েছে এবং তাদের নাম ও উপাসনার পদ্ধতিতেও বিভিন্নতা এসেছে।
ঈশ্বর কেন শয়তানকে মন্দ কাজ করার অনুমোদন দিয়েছেন?
একজন হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, কেন সর্বজ্ঞ ঈশ্বর (প্রেরিত্ ২:২৩; রোমীয়
৮:২৯-৩০। গালাতীয় ৩:৮: ১ পিতর ১:২, ২০ পদ দ্রষ্টব্য) পূর্ব-নির্দিষ্ট করে রেখেছিলেন যে, এরকম মন্দ কাজ হবে। যেহেতু ঈশ্বর হচ্ছেন সর্বশক্তিমান (আদি পুস্তক ১৭:১: ১৮:১৪; যিরমিয় ৩২:১৭: মথি ১৯:২৬: প্রকাশিত বাক্য ১৫:৩ পদ প্রষ্টব্য), সেহেতু তিনি খুব সহজেই লুসিফারের পতন ঠেকাতে পারতেন। হ্যাঁ, তিনি তা করতে সমর্থ ছিলেন। তবু তিনি কেন এই মন্দ কাজ করতে দিলেন?
আবার, হয়তো বা এরকম প্রশ্নও আসতে পারে, ঈশ্বর কেন পতিত লুসিফারকে সাথে সাথে আগুনের হ্রদে ফেলে দেন নাই? যদি লুসিফার ও তার অনুসারীদের পতনের সাথে সাথে আগুনের হ্রদে ফেলে দেওয়া হোত, তাহলে প্রথম ও দ্বিতীয় স্বর্ণ উভয়ই ধ্বংস হোত না। তাহলে, আদমেরও পতন হোত না এবং এই পৃথিবীতে এসে আদমের বংশকে উদ্ধার করতে যীশুকেও আসতে হোত না।
বাস্তবিক, এই সব ঘটনার পিছনে ঈশ্বরের সুস্পষ্ট কারণ ও উদ্দেশ্য ছিল, কারণ তিনি এই সবই অনুমোদন করেছিলেন। এটা ছিল ঈশ্বরের আত্মিক পরিকল্পনা: তিনি তাঁর মনোনীত লোকদের সৃষ্টির প্রকৃত উদ্দেশ্য শিক্ষা দিতেই পতিত লুসিফারকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছেন। সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরকে গৌরব দেওয়াই হলো সৃষ্টির প্রকৃত উদ্দেশ্য।
এই শিক্ষা দেবার পরিকল্পনা সৃষ্টির আগে থেকেই পূর্ব-নির্দিষ্ট ছিল। ঈশ্বরের এই শিক্ষার মধ্যে যে যে বিষয়সমূহ রয়েছে, তা হল:
১) লুসিফারের পতন অবশ্যই হবে,
২) আদমের পতনও অবশ্যই হবে,
৩] এই যুগের দেবতা হিসাবে পতিত লুসিফার অবশ্যই শক্তি অর্জন করবে (২ করিন্থীয় ৪:৪ পদ দ্রষ্টব্য),
৪] পতিত লুসিফার অবশ্যই পৃথিবীর ধর্মগুলোর প্রধান হয়ে উঠবে,
৫) পতিত লুসিফারকে ধ্বংস করার জন্য যীশু এই পৃথিবীতে মানুষ হয়ে আসবেন। ঈশ্বর তাঁর প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা পূর্ণ করার জন্যই পতিত লুসিফারের চরিত্রে ঈর্ষা উৎপন্ন করেছিলেন।
এই কারণে, ঈশ্বর এক সুনির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা প্রস্তুত করেছেন, যা হচ্ছে ৭০০০ বছরের এক সুদীর্ঘ পরিকল্পনা (আদমের পতন থেকে শুরু করে শেষ বিচার পর্যন্ত)। যেহেতু আমরা আমাদের মানবীয় বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা দিয়ে এই বিষয় বুঝতে পারি না, সেহেতু আমাদের অবশ্যই পবিত্র আত্মার সাহায্য প্রয়োজন রয়েছে
0 coment rios: